পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে দিলরুবা বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। মা সবসময়ই বলতেন, ছোটবেলা থেকে অন্য ভাই-বোনদের তুলনায় তিনি অনেকটা আলাদা। নিজের তাগিদেই পড়াশোনা করতেন। দুঃসম্পর্কের এক চাচাতো ভাইকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং বাংলাদেশ নেভি কলেজ থেকে উচ্চ-মাধ্যমিক শেষ করার পর চুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং- এ ভর্তি হন। সাধারণত এই বিষয়ে পুরুষরাই বেশি পড়াশোনা করে থাকে বলে আশেপাশের মানুষ, আত্মীয়-স্বজন সহ অনেকেই তার এই বিষয় নিয়ে পড়াশুনাতে উৎসাহ দেয়নি । তবে, বাবা-মা সব সময়ই দিলরুবাকে সমর্থন ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।
দিলরুবা আহমেদ চৌধুরী ২০০৭ সালে প্রথম চাকরি জীবন শুরু করেন টেক্সটাইল খাতে, টেকনিক্যাল সেলস ম্যানেজার হিসেবে। প্রথমদিকের অভিজ্ঞতা স্বচ্ছন্দময় ছিলনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের বড় আপুরাও বলতেন, টেকনিক্যাল সেলসকে পেশা হিসেবে নেওয়া মেয়েদের জন্য একটি কঠিন সিদ্ধান্ত। যেহেতু ক্যারিয়ার মাত্রই শুরু করেছেন, তখন বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন তিনি।
সে সময় টেক্সটাইল খাত বর্তমান সময়ের মতো ছিল না- বিশেষ করে মেশিনারি বেচা-কেনা কিংবা সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কোনো বিষয়ে বোঝাপড়া করা। তখন তিনি ভাবলেন, নিজেকে যতটা প্রমাণ করা দরকার ছিল, তা তিনি জানতে পেরেছেন। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি অনেক বদলে গিয়েছে। এই খাতে এখন প্রচুর নারী-কর্মী কাজ করছে। দিলরুবা মনে করেন, নিজের সক্ষমতার ওপর বিশ্বাস না করলে এই অর্জনটুকু পাওয়া সম্ভব হতো না।
২০১০ সালে ইউনিলিভারে আসার পর দিলরুবার জীবন আমূল বদলে যায়। কেননা, এই প্রতিষ্ঠানটি নারী-পুরুষের কর্মদক্ষতাকে সমানভাবে বিবেচনা করে। এত বছর তার এখানে কাজ করার পেছনে এটা একটা অন্যতম কারণ। এখানে কাজ করার সময় তার কখনোই মনে হয়নি তিনি একজন নারী হিসেবে এখানে কাজ করছেন। ইউনিলিভারে কাজ করা সম্পর্কে বলতে গিয়ে দিলরুবা জানান, এখানে কাজ করতে পারাটা তার জন্য অনেক গর্বের।
ইউনিলিভার এ সমান প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল কর্মীকেই নিজেকে প্রমাণ করে এখানে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে হয়। দিলরুবাও এর ব্যতিক্রম নন। বিশেষ করে দুটি ঘটনার কথা তিনি উল্লেখ করেন, “আমার দুই সন্তানের জন্ম হয়েছে ইউনিলিভার বাংলাদেশে আসার পর। প্রথমবার মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটানোর সময় আমার প্রথম পদোন্নতি হওয়ার মতো অসাধারণ অভিজ্ঞতা পেয়েছি ইউনিলিভারের মাধ্যমে। তারমানে, এই প্রতিষ্ঠান আমার কর্মদক্ষতা দেখে আমাকে পুরস্কৃত করছে, নারী হিসেবে নয়। এখানে নারী কর্মীর সংখ্যা বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ প্রতিষ্ঠানটির নারী-বান্ধব পরিবেশ।
দিলরুবার সাফল্যের পেছনে তার অসমান্য পরিশ্রমের পাশাপাশি সহায়ক ভূমিকা রেখেছে ইউনিলিভারের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, যা সর্বদা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের নিরাপত্তার জন্য কাজ করেছে। ইউনিলিভারের কর্মীদের সন্তানদের দেখ-ভালের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার রয়েছে। সময়মতো অফিসে আসার গৎবাঁধা নিয়মের বাইরে গিয়ে ইউনিলিভার সকল কর্মীকে প্রয়োজনে ছাড় দেয়। এমনকি দরকার হলে বাড়িতে বসেই অফিসের কাজ করার সুবিধা পান ইউবিএল- এর কর্মীরা। মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের জন্য রয়েছে ব্যক্তিগত বাহন। পাশাপাশি তাদের থাকার ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রেও সহায়তা করে প্রতিষ্ঠানটি। কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় জন্য ইউনিলিভারের একটি অন্যতম বিশেষ উদ্যোগ হলো পরিবার নিয়ে বাধ্যতামূলক বিনোদনের ব্যবস্থা করা।
পেশাজীবী নারীদের উৎসাহ দিয়ে তাদের সাফল্য অর্জনে সহযোগিতার জন্য রয়েছে ইউবিএল- এর “শি ফর শি”, যেখানে তারা তাদের অভিজ্ঞতা ও চিন্তা-ভাবনা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করেন ও একে অপরকে সহযোগিতা, উৎসাহ ও উদ্বুদ্ধ করে একটি সামগ্রিক নারী সহায়ক কর্ম-পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেন। নারীদের শারীরিক ও মানসিক প্রয়োজনে পাশে থাকার জন্য ইউবিএল- এর আরেকটি প্ল্যাটফর্ম হলো #স্ট্যান্ডস্ট্রং। শুধু তাই নয়, মাতৃত্ব-কালীন ও পিতৃত্বকালীন ছুটি, কর্মজীবনে বিরতি, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ, পরিবারে হয়রানির শিকার হওয়া কর্মীদের সমর্থন করা এবং বিনিময়যোগ্য ছুটির নীতিও বাস্তবায়ন করেছে ইউবিএল।
কর্মক্ষেত্রে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় সব ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ জরুরি। পর্যাপ্ত সাপোর্ট সিস্টেম না থাকায় অনেক নারীই কর্মক্ষেত্রে ঝরে পড়ছে। তাই তিনি বলেন, “চাকরির নীতির বাইরেও একজন নারী কর্মীর জন্য প্রতিষ্ঠানের ফ্লেক্সিবিলিটি (নমনীয়তা) ও এজিলিটি (তৎপরতা) থাকা জরুরি। ইউনিলিভারের এই অসাধারণ উদ্যোগগুলো অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও অনুসরণ করতে পারে।” দিলরুবা টিমের নারী কর্মকর্তাদের সুবিধা-অসুবিধাগুলো বিবেচনা করেন। তারাও দিলরুবাকে একইভাবে মূল্যায়ন করে এবং সম্মান দেয়, যা তার কাছে অনেক বড় অর্জন।
ইউনিলিভারে অবদান রাখায় দিলরুবা ডিএনআই চ্যাম্পিয়ন ফর ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক এবং স্পেশাল চেয়ারম্যান’স রিকগনিশন অ্যাওয়ার্ডের মতো বিশেষ অনেক পুরস্কার অর্জন করেছেন। এছাড়া শিক্ষাজীবনে পড়াশোনার পাশাপাশি দিলরুবা ছিলেন তার ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখ। কেননা উপস্থাপনা, বিতর্ক, আবৃত্তি ও খেলাধুলার মতো নানা পাঠক্রম বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। সেখানেও তিনি পেয়েছেন বিভিন্ন পুরস্কার।
জীবনে কে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, এমন প্রশ্নে দিলরুবা তার বাবার কথা বলেন। সৎ, নিয়মতান্ত্রিক ও সাধারণ জীবন-যাপন করা বাবার মতো করে তিনিও চলার চেষ্টা করেন। নিজের মেয়েদের তার বাবা অনেক উৎসাহ দিতেন। দিলরুবা বলেন, “ আরেকজন মানুষের অনুপ্রেরণা বা সমর্থন না পেলে এতদূর আসাটা সহজ হতো না। তিনি আমার শাশুড়ি মা। আমার পুরো ক্যারিয়ার ও সংসারে তিনি অন্যতম বড় সহায়ক ভূমিকা রেখেছেন। আমার সন্তানদের দেখাশোনা করা এবং সংসার সামলানোর মতো এত বড় দায়িত্ব তিনি হাসিমুখে পালন করছেন বলেই, কোনো সাংসারিক ঝামেলা ছাড়াই আজ আমি এতদূর আসতে পেরেছি।”