ইউনিলিভার বিশ্বের প্রায় ১৯০টি দেশের প্রায় ৩৫০ কোটি মানুষের জন্য ভোগ্যপণ্য উৎপাদন করে। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা এসব ভোক্তার ওপরই আমাদের ব্যবসার সমৃদ্ধি নির্ভর করে। ভোক্তাদের জীবন আরও সুন্দর, স্বাচ্ছন্দ্যময় ও ইতিবাচক করতে ইউনিলিভার কাজ করে।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন বা অন্য কোনো কারণে যদি ভোক্তাদের জীবনে কোনো সংকট আসে বা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তাহলে কিন্তু ব্যবসাও সংকটে পড়বে। তাই মানুষের জীবন ও সমাজের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে টেকসই উন্নয়নকে মাথায় রেখে ইউনিলিভার ২০১০ সালে সাসটেইনেবল লিভিং প্ল্যান (ইউএসএলপি) ঘোষণা করে। এ পরিকল্পনা কিন্তু কেবল কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে ছিল না, বরং এই কৌশলের লক্ষ্য ছিল, কোম্পানির পরিবেশগত প্রভাব অর্ধেক করার পাশাপাশি টেকসই উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আরও দুটি ক্ষেত্র—মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা আর জীবিকার উন্নয়নেরও ইতিবাচক অবদান রাখা।
আমার মনে আছে, এই উদ্যোগ নিয়ে সে সময় প্রতিষ্ঠানের ভেতর ও বাইরে অনেক আলোচনা হয়েছে। সে সময়ের বিবেচনায় এই ব্যবসায়িক কৌশল যুগান্তকারী একটি ধারণা ছিল। কারণ, তখন পরিবেশ সংরক্ষণ বা বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগকে মূলত ঐচ্ছিক সামাজিক দায়বদ্ধতা হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু ইউএসএলপি সে ধারণা ভেঙে দিয়ে টেকসই উন্নয়নকে ব্যবসার মূল ধারায় নিয়ে এসেছিল।
প্রায় ১০ বছর ধরে এই কৌশল কাজ করার পর যখন টেকসই উন্নয়ন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কাজ করা আমাদের সবার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে গিয়েছিল, তখন ইউনিলিভার ইউএসএলপির পরবর্তী ধাপ ‘ইউনিলিভার কম্পাস’ ঘোষণা করে। এই পরিবর্তনের ভিত্তি ছিল ইউএসএলপি বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা আর সচেতনতা। কম্পাসকে আমাদের মূল ব্যবসায়িক নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে ইউনিলিভার প্রতিষ্ঠানের সব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। ২০১০ সাল থেকে টেকসই উন্নয়নকে ইউএসএলপি আর কম্পাসের মধ্যমে ব্যবসা কৌশল হিসেবে সফলভাবে কার্যকর করার কারণে ইউনিলিভার টানা ১২ বার গ্লোবাল স্ক্যানের সমীক্ষা অনুসারে বিশ্বের সেরা টেকসই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
কোভিড-১৯–পরবর্তী সময়ে বিশ্বের পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে টেকসই উন্নয়নের নতুন কিছু ক্ষেত্র আর প্রয়োজনীয়তার সৃষ্টি হয়। পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে নতুন লক্ষ্য আর মধ্যমেয়াদি কিছু লক্ষ্য দ্রুত বাস্তবায়নের কথা চিন্তা করে ইউনিলিভার ২০২৩ সালে নতুন গ্রোথ অ্যাকশন প্ল্যান ঘোষণা করে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, আরও দ্রুত ও কার্যকরভাবে বিশেষ কিছু লক্ষ্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অর্জনে অধিক হারে সম্পদ ও শ্রম বিনিয়োগ করা।
গ্রোথ অ্যাকশন প্ল্যানের অধীনে ইউনিলিভার জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ সংরক্ষণ, প্লাস্টিক দূষণ ও জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত আর কার্যকর ভূমিকা নিতে কাজ করার পরিকল্পনা করছে। এসব বিষয় নিয়ে আমাদের দীর্ঘ মেয়াদে কাজ করা প্রয়োজন। কিন্তু বিষয়গুলোর কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের এখনই কিছু স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি লক্ষ্যও অর্জন করতে হবে। সেসব লক্ষ্য পরিমাপযোগ্যও হতে হবে।
আমি নিজে এসব অগ্রাধিকার নিয়ে ইউনিলিভারের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বাস্তবিক প্রয়োজনীয়তা আর ফলাফল দেখার সুযোগ পেয়েছি। যেমন কম্পাসের দীর্ঘমেয়াদি একটি লক্ষ্য ছিল, একটি বর্জ্যমুক্ত পৃথিবী গড়তে অবদান রাখা। প্লাস্টিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইউনিলিভার যেমন নিজেদের প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্যাকেজিং ব্যবহারের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, তেমনি ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সার্কুলারিটি প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে কাজ করার অঙ্গীকার করেছে। বাংলাদেশের মতো দেশের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের উদ্যোগগুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কারণ, আমাদের দেশে এখনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আর রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রি মূলত অনানুষ্ঠানিক খাত দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ভ্যালু চেইনের উন্নয়নে অনেক অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে প্লাস্টিক রিসাইক্লিং ব্যবসা বর্তমানে দেশের ৩৭ শতাংশ প্লাস্টিককে রিসাইকেল করছে এবং আরও চাহিদা থাকা সত্ত্বেও রিসাইকেল করার জন্য তারা যথেষ্ট পরিমাণ মানসম্পন্ন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করতে পারে না। অথচ প্রতিদিন আমাদের বিভিন্ন সিটি করপোরেশন থেকে বেশ কয়েক‘শ টন প্লাস্টিক বর্জ্য আমরা রিসাইকেল না করতে পেরে ল্যান্ডফিলে (ভাগাড়ে) ফেলে দিতে বাধ্য হচ্ছি। এ ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা বা সদিচ্ছা নয়, মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্যের সঠিক ভ্যালু চেইন প্রতিষ্ঠা না করতে পারা এবং সাধারণ ব্যবহারকারীদের সচেতনতা।
আমরা যদি এখনই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সঠিক পরিকল্পনা না করি, তাহলে আমাদের শহরগুলোয় হয়তো আগামী দিনগুলোয় শিশুদের খেলার জন্য কোনো মাঠ অবশিষ্ট থাকবে না। তাই আগামী দিনের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে আমাদের সীমিত ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার খুব প্রয়োজন। কাকতালীয়ভাবে এ বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ল্যান্ড রিস্টোরেশন বা ভূমি পুনরুদ্ধার করা। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে প্রচলিত ল্যান্ড রিস্টোরেশন উদ্যোগ যেমন বনায়ন বা মরুকরণ প্রতিরোধের মতো বিষয়গুলো যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনিভাবে আমাদের শহরগুলোয় প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধ করার মাধ্যমে ল্যান্ডফিলের ব্যবহার কমানোর মতো বিষয়গুলোও আমাদের শহরগুলোর ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি নিয়ে এখন থেকেই আমাদের সচেতন হতে হবে।
ভোগ্যপণ্য নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি যে ভবিষ্যতে কী কী পরিবর্তন আর চাহিদা আসতে যাচ্ছে, সেটা সঠিকভাবে আগে থেকে অনুমান করা সম্ভব না হলে ব্যবসায় টিকে থাকা কঠিন। আমি মনে করি, পরিবর্তিত বাস্তবতায় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর জলবায়ু পরিবর্তন বা পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে শুধু দিবসকেন্দ্রিক বা প্রতীকী উদ্যোগ নেওয়া থেকে বের হয়ে এসে আরও বেশি কিছু করা প্রয়োজন। প্রয়োজন টেকসই উন্নয়নকে বিকাশের আগামী দিনের নতুন ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা।