সাবানের মাধ্যমে লাখ লাখ বাংলাদেশীর স্বাস্থ্যের মানোন্নয়ন
বঙ্গীয় ব-দ্বীপ (গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র- মেঘনা নদীর অববাহিকা, যা বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডের প্রায় ৩৫%) ঐতিহাসিকভাবেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত, যেখানে ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা পণ্য ক্রয়-বিক্রয় বা বিনিময় করা হত। এই বাণিজ্যের কারণেই শত শত বছর ধরে বাংলায় মধ্যপ্রাচ্যের সুগন্ধি সাবান বা দক্ষিণ ভারতের চন্দন (স্যান্ডেলউড) সমৃদ্ধ সাবানের মত পণ্যের প্রচলন ছিল। সেই সময়ের অভিজাত ব্যাক্তিরা উন্নতমানের এসব সাবান ব্যবহার করতে পারলেও, সাধারণ মানুষ তাদের সীমিত ক্রয় ক্ষমতার কারণে ত্বকের যত্ন ও চুল পরিষ্কারের কাজে প্রায়ই বিশেষ ধরনের কাদামাটি বা ছাই ব্যবহার করতেন।

আভিজাত্য থেকে জীবনরক্ষাকারী: বাংলায় সাবানের বিবর্তন
শিল্প বিপ্লবের প্রভাব বাংলায় ছড়িয়ে পড়ার পর ইউরোপের তৈরি অন্য অনেক পণ্যের মতো সাবানও এদেশে আমদানি হতে শুরু হয়। ১৮৮৮ সালে, ‘লিভার ব্রাদার্স কর্তৃক ইংল্যান্ডে প্রস্তুতকৃত (Made in England by Lever Brothers)’ সীল দেয়া ক্রেট ভর্তি সানলাইট সাবানের প্রথম চালান পৌঁছায় কলকাতায়। এর মধ্য দিয়েই ভারতীয় উপমহাদেশে ইউনিলিভার-এর সাবানের যাত্রা শুরু হয়।
১৮৯৫ সালে, সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসুরক্ষার প্রতিশ্রুতির সাথে লাইফবয়-এর যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে, লাইফবয়, সানলাইট ও পেয়ার্সের মতো সাবানগুলো ঢাকা ও চট্টগ্রামে মানুষের হাতের নাগালে আসতে থাকায়, সেসব দ্রুত জনপ্রিয় হতে শুরু করে।
ভৌগলিকভাবে বাংলা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় নদীমাতৃক ও প্লাবনভূমি হবার কারণে এখানে স্বাভাবিকভাবেই বন্যার প্রাদূর্ভাব ছিল। বন্যার পরবর্তী সময়ে পানিবাহিত রোগ যেমন ডায়রিয়ার কারণে মৃত্যুর প্রকোপ দেখা যেত। এমনকি ষাটের দশকেও প্রতি দশটি শিশুর মধ্যে একটি শিশুর বয়স ৫ বছর হবার আগেই তারা মারা যেতো। এর পেছনের অন্যতম প্রধান একটি কারণ ছিলো স্বাস্থ্যকর সাবানের প্রাপ্যতা ও ব্যয়বহুলতা।
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যকর সাবান সহজলভ্য বা সাশ্রয়ী ছিল না। ফলে মানুষকে মূলত ঘরোয়া ও নিম্নমানের বিকল্প পণ্যের ওপর নির্ভর করতে হতো। মানসম্পন্ন সাবানের উৎপাদনের বেশিরভাগ কারখানাগুলো ছিল বোম্বে (মুম্বাই) অথবা করাচি কেন্দ্রিক। সাবানগুলো দুর্মূল্য ও দুর্লভ হবার এটা ছিলো অন্যতম একটি কারণ।

ইউনিলিভার-এর মাইলফলক: জনগণের কাছে সহজলভ্য হয়ে উঠলো লাইফবয়
সাবান সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে ও সাধ্যের মধ্যে আনতে ইউনিলিভার ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামে তাদের প্রথম সাবানের কারখানা স্থাপন করে। ইউনিলিভার-এর কালুরঘাট ফ্যাক্টরি (কেজিএফ) থেকে ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লাইফবয় সাবানের উৎপাদন শুরু হয়। স্বাস্থ্যকর এ সাবান দেশের মানুষের জন্য ছিলো একটি গেম চেঞ্জার। সাবানকে সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে ইউনিলিভার-এর উদ্যোগ যেমন অসংখ্য মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে, তেমনি মানুষের জীবনমানও উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করেছে। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই, দেশের মানুষের কাছে লাইফবয় হয়ে উঠে পরিচ্ছন্নতা আর সজীবতার এক প্রতীক।
লাইফবয় দেশের প্রথম বহুল উৎপাদিত সাবান। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর কাঁচামালের সংকটের কারণে কালির ব্যবহার বাঁচাতে লাইফবয় সাবানে লালের পরিবর্তে সাদাকালো মোড়ক ব্যবহার করা হয়। সেই সময়ে চাহিদার কারণে লাইফবয় সাবান সরকারিভাবে রেশনিং পর্যন্ত করা হতো। ডিলার পয়েন্টে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতি ও তদারকিতে সাবান বিক্রি করা হত যাতে করে নিশ্চিত করা যায় যে কেউ একবারে দুটির বেশি সাবান না কিনতে পারে। এমনকি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর বিতরণ করা জরুরী ত্রাণের সামগ্রীর মধ্যে সবসময় লাইফবয় সাবানও দেয়া হতো।

সাবানের বাইরে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও পরিচ্ছন্নতায় লাইফবয়-এর অবদান
লাইফবয় ব্র্যান্ডটি বাংলাদেশের মানুষের জীবনের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও পরিচ্ছন্নতা নিয়ে কাজ করবার অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে লাইফবয় এখনও সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে কাজ করে চলছে। ১৯৯০ এর দশক থেকে লাইফবয় বাংলাদেশে হাত ধোয়া ও ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। গত তিন দশকে এই কার্যক্রম ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে দেশব্যাপী স্কুলের শিক্ষার্থী ও সমাজের মানুষদের মাঝে সঠিকভাবে হাত ধোয়া ও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবার অভ্যাস সৃষ্টি করতে যে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে, তা নিয়ে আমরা গর্বিত।
জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় লাইফবয়-এর অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে, বৈশ্বিক মহামারির সংকটময় সময়েও লাইফবয় পরিচ্ছন্নতা ও সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যের যোগান ও প্রাপ্যতা নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়াও, ব্র্যান্ডটি ‘স্কুল অব ফাইভ’ ও ‘এইচ ফর হ্যান্ডওয়াশিং গেমস্’ এর মতো বড় পরিসরে জাতীয়ভাবে প্রচারণায় নেতৃত্ব দিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করেছে, যা দিয়ে উপকৃত হয়েছে দেশের প্রায় ১২ কোটি সাধারণ মানুষ।
হাতধোয়ার মতো অভ্যাস গড়ে তোলা ছাড়াও, ২০০২ সালে লাইফবয় ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের (এলএফএইচ) প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের মানুষের প্রতি লাইফবয়-এর অঙ্গীকারের প্রতীক হয়ে আছে। এলএফএইচের মাধ্যমে দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রত্যন্ত চরের প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষকে মানসম্মত চিকিৎসা সেবা দিতে সক্ষম হয়েছে লাইফবয়।
লাইফবয় এমন একটি ব্র্যান্ড যা বিগত ১৩০ বছর ধরে কোটি মানুষের জীবনে ইতিবাচক অবদান রেখেছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে শিশুদের পানিবাহিত রোগে মারা যাবার সম্ভাবনা ৯০% কমে গেছে এবং এর পিছনে সাবানের জনপ্রিয়তা ও সহজলভ্যতার বিশেষ অবদান রয়েছে। ছয় দশক আগে কেজিএফ থেকে প্রথম উৎপাদিত সাবানগুলি যে সত্যিই জাতির জন্য বিশেষ কিছু ছিল, এটা তাই প্রমাণ করে।
সবার সুস্বাস্থ্য ও ওয়েলবিং নিশ্চিত করে এসডিজি:৩ বাস্তবায়ন করতে লাইফবয় সদা বদ্ধপরিকর। রোগমুক্ত ও স্বাস্থ্যবান আগামী প্রজন্ম বিনির্মানে ভবিষতেও বাংলাদেশের সঙ্গী হয়ে কাজ করবে লাইফবয়।