ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড (ইউবিএল) বাংলাদেশের অন্যতম ফাস্ট-মুভিং কনজিউমার গুডস (এফএমসিজি) কোম্পানি, যার রয়েছে বহু জনপ্রিয় ব্র্যান্ড, দেশজুড়ে বিস্তৃতি এবং সুচিন্তিত টেকসই উন্নয়ন কার্যক্রমের ইতিহাস। কোম্পানিটি আজ লাখো বাংলাদেশি গ্রাহকের ভালোবাসায় সিক্ত।
তবে এই কোম্পানি, যার সূচনা হয়েছিলো এদেশের সূদুরে এবং সময়ের সাথে এই অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব হয়ে ওঠার গল্পটি যেমনই অনন্য, তেমনই রোমাঞ্চকর। ইউনিলিভার, যে কোম্পানির শুরু ইংল্যান্ডের পোর্ট সানলাইটে, যখন এই লাল-সবুজের দেশে যাত্রা শুরু করেছিলো, তার যাত্রার প্রতি পদে ছিলো নানা ঘটনার আবর্তন।
ব্যবসায়ীকরণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ঐতিহ্য
বেঙ্গল ডেল্টা - বর্তমান বাংলাদেশ যার অন্তর্ভুক্ত, ইউরোপীয় ও আরবীয় ব্যবসায়ীদের কাছে তার সম্পদের জন্য সুপরিচিত ছিল। বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে বাংলার এই অঞ্চল ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের, মূলত ব্রিটিশ, ফরাসি এবং ডাচদের আকর্ষণ করে। এই ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা কৃষি সম্পদের জন্য বাংলায় এসে চাল ও নীলের মতো কাঁচামাল ইউরোপে রপ্তানির সম্ভাবনা যাচাই করেন। অনেক ইউরোপীয় ব্যবসায়ী, যেমন নরউইচের কোলম্যান, যিনি নর (Knorr) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ১৮৫৬ সালের শুরুতেই বাংলায় ট্রেডিং এজেন্ট পাঠান।
আঞ্চলিক বিস্তৃতি, নতুন সম্ভাবনার যাত্রা
ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের শীর্ষ সময়ে, ব্রিটেনে উৎপাদিত অনেক পণ্য ভারতীয় উপমহাদেশে সহজলভ্য হতে শুরু করে। ১৮৮৮ সালে সানলাইট সাবান বারের এরকমই একটি চালান এসেছিল, যার উপর লেখা ছিল "মেড ইন ইংল্যান্ড বাই লিভার ব্রাদার্স"। এরই মাধ্যমে এই অঞ্চলে ইউনিলিভার-এর যাত্রা শুরু হয়।
১৯৩০-এর দশকে, লিভার ব্রাদার্স-এর সাবান, যেমন লাইফবয়, সানলাইট, পিয়ার্স, স্থানীয় বাজারে জনপ্রিয় হয়ে উঠে, যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে জায়গা করে নেয়। ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণেই এই অঞ্চলে লিভার-এর পণ্যগুলোর স্থানীয় উৎপাদন শুরু করার মত সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একই সাথে, ১৯১৮ সালে মার্জারিন ইউনি (অ্যান্টুন জার্গেন্স ইউনাইটেড) এর পূর্বসূরীরা, ডালডা বনস্পতি ঘি উৎপাদন শুরু করেন, যা বাংলাসহ সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
১৯৩০ এর দিকে বৈশ্বিকভাবে একীভূত হওয়ার পরে এই দুই কোম্পানি ভারতীয় উপমহাদেশেও একসাথে কাজ করতে শুরু করে। ভারতীয় উপমহাদেশ বিভাজনের পরে, ইউনিলিভার ব্যবসা সম্প্রসারণের আরও নতুন সব সম্ভাবনা খুঁজতে শুরু করে। পূর্ব বাংলায় ততদিনে তাদের ভাল বাজার তৈরী হয়ে গিয়েছিলো। তাদের পণ্যের জন্য আগে থেকেই সেলস এজেন্ট ও পরিবেশক থাকলেও পণ্যগুলো আমদানি করতে হতো।
লন্ডনে অবস্থিত ইউনিলিভার-এর ওভারসিজ কমিটির একাধিক পরিদর্শনের পর, পূর্ব বাংলায় ইউনিলিভার-এর প্রথম কারখানা স্থাপনের জন্য চট্টগ্রামকে বেছে নেওয়া হয়। কাঁচামাল আমদানির সুবিধার্থে এবং প্যাকেজিংয়ের জন্য তৎকালীন পূর্ব বাংলার একমাত্র কাগজ মিল, চন্দ্রঘোনা পেপার মিলের ব্যবহার মাথায় রেখে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বন্দর থেকে কাছে হওয়ায় এবং কর্ণফুলী নদী ও ভবিষ্যতে সম্প্রসারণের জন্য যথেষ্ট জায়গা পাবার সম্ভাবনার কারণে কালুরঘাটকে বেছে নেওয়া হয়েছিলো।
ইউনিলিভার বাংলাদেশ: অগ্রগতি এবং টেকসই উন্নয়নের প্রতীক
কারখানাটির নির্মাণ কাজ ১৯৬২ সালে শুরু হয় এবং ১৯৬৪ সালে এখানে পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন আরম্ভ হয়। ১৯৬৫ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি কালুরঘাট ফ্যাক্টরি (KGF) আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়, যা এই লাল সবুজের বাংলায় ইউনিলিভার-এর শিল্পোৎপাদন ঐতিহ্যের প্রতীক। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের সাথে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর পর, সেই বছরের ৫ জুলাই লিভার ব্রাদার্স বাংলাদেশ লিমিটেড এদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে, যেখানে সরকার ৩৯.২৫% শেয়ারের মালিকানা পায়।
কেজিএফের প্রতিষ্ঠা কালুরঘাটের অবস্থা সম্পূর্ণরূপে বদলে দেয়। ৬০ এর দশকের কৃষিপ্রধান একটি এলাকা থেকে কালুরঘাট বাংলাদেশের প্রথম ভারী শিল্প এলাকায় পরিণত হয়। এবং অন্যান্য অনেক কোম্পানি এই এলাকার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠে।
আজ ইউবিএল গর্বের সাথে প্রতি ১০টির মধ্যে ৯টি বাংলাদেশি পরিবারের ঘরে সর্বোচ্চ মানের পণ্য পৌঁছে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, এই দেশের সাথে মিলে প্রতিটি বাংলাদেশির জন্য পরিবেশ রক্ষা, ভোক্তাদের সুস্থতা নিশ্চিতকরণ এবং স্টেকহোল্ডারদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে টেকসই আগামীর পথে অগ্রযাত্রার ব্যাপারেও ভূমিকা রাখছে ইউবিএল।