কালের পরিক্রমায় বাংলাদেশে ইউবিএল- এর ছয় দশকের যাত্রায় একে একে যুক্ত হয়েছে লাইফবয়, ক্লোজআপ, পেপসোডেন্ট, গ্লো অ্যান্ড লাভলী, হুইল, রিন, ডাভ, ক্লিয়ারের মতো নানা ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। বাংলাদেশের ভোক্তাদের নিত্যদিনের চাহিদা বিবেচনা করে তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে বাজারে পণ্য সরবরাহ করতে থাকে ইউনিলিভার বাংলাদেশ। দেশের প্রতি ১০টি পরিবারের মধ্যে ৯টি পরিবারেই ইউনিলিভারের পণ্য ব্যবহৃত হয়।
চট্টগ্রামের কালুরঘাটে সাবান তৈরির ফ্যাক্টরি থেকে শুরু করে বর্তমানে বাংলাদেশে ২৬টিরও বেশি প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের মাধ্যমে দেশের বৃহত্তম এফএমসিজি প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার গল্পটা সব সময়ই রোমাঞ্চকর ছিল ইউবিএল- এর জন্য। কেননা এ প্রতিষ্ঠান জনগণের দোড়গোড়ায় নিত্যপণ্য পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি ওয়াশ (ওয়াটার, স্যানিটেশন অ্যান্ড হাইজিন) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের আচরণগত পরিবর্তন সাধন করা, দাঁতের যত্ন ও পুষ্টি নিয়ে কাজ করা, নতুন নতুন উদ্ভাবনী চিন্তা কাজে লাগিয়ে সমাজের নিম্ন-আয়ের মানুষের কাছে সাবান-শ্যাম্পুর মিনি-প্যাক পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের দ্বারপ্রান্তে চিকিৎসা সুবিধা পৌঁছে দিতে এ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম একটি উদ্যোগ হলো লাইফবয় ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল (এলএফএইচ)। ২০০৩ সালে ইউনিলিভারের পণ্য লাইফবয় ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ফ্রেন্ডশিপের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে জাহাজের ওপর ভাসমান এ হাসপাতালের যাত্রা শুরু হয়। এখন পর্যন্ত এ হাসাপাতালের মাধ্যমে ছয় লাখেরও বেশি চরাঞ্চলের মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে আসছে ইউবিএল। নব্বইয়ের দশক থেকে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাংলাদেশের শিশু ও অভিভাবকদের হাত ধোয়া প্রশিক্ষণ এবং দাঁত পরিষ্কার রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে আসছে ইউনিলিভার।
শুধুমাত্র ২০২১ সালেই ইউবিএল এ প্রোগ্রামের আওতায় ১৩টি উদ্যোগের মাধ্যমে সারাদেশের পাঁচ কোটি জনগণের কাছে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ক বার্তা পৌঁছে দিয়েছে, যা জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) পাঁচটি লক্ষ্য পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়াও, করোনা মহামারির সময় বিভিন্ন হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সদের সহায়তা করতে ৪৫ লাখ প্রয়োজনীয় কিট সরবরাহের পাশাপাশি ৮ কোটি টাকার হেলথ অ্যান্ড হাইজিন পণ্য সহায়তা প্রদান করেছে এফএমসিজি প্রতিষ্ঠানটি।
ইউনিলিভার বাংলাদেশ নিজস্ব সক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশের প্লাস্টিক সার্কুলারিটি অর্জনের জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং ইপসা (ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল এ্যাকশন)-এর সঙ্গে কাজ করেছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে ২০২২ সাল থেকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে প্রতিদিনের প্রায় ১০ শতাংশ প্লাষ্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে প্লাষ্টিক সার্কুলারিটি নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রায় তিন হাজার পরিচ্ছন্নতা কর্মীর জীবিকার উন্নয়ন ঘটেছে। এই অংশীদারিত্ব ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরির সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার মাধ্যমে শহরের ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটায়।
প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত অ্যাকশন প্ল্যান (২০২১-২০৩০) এর মধ্যে ইউবিএল- এর এই উদ্যোগটি এখন একটি সফল মডেল। ‘ইউনিলিভার কম্পাস’ শীর্ষক বৈশ্বিক টেকসই ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে ‘ক্লাইমেট ট্রানজিশন অ্যাকশন প্ল্যান’ এর আওতায় কৌশলগত লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি, যাতে ২০৩০ সালের মধ্যে ইউনিলিভার তাদের কার্যক্রমে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে পারে এবং ২০৩৯ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের ভ্যালু চেইন জুড়ে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা একেবারেই শূন্য হয়।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বল্প শিক্ষিত বেকার তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। ‘পল্লীদূত’ প্রকল্পটি কোম্পানির এমন কিছু উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে পরিবেশকদের কাছ থেকে পণ্য নিয়ে একেবারে প্রত্যন্ত ও সুবিধাবঞ্চিত এলাকাগুলোতে পণ্য সরবরাহের কাজ করে এসব তরুণরা। প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যত নেতৃত্ব তৈরির জন্য নেওয়া বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার উদ্যোগ রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো ‘বিজমায়েস্ট্রোস’। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলায় ইউনিলিভার সবার কাছে ‘স্কুল অব লিডার্স’ নামেও পরিচিত। ট্যালেন্ট বিল্ডার হিসেবে ইউনিলিভার কয়েক প্রজন্ম ধরে খ্যাতনামা অনেক ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছে, যারা দেশে-বিদেশে কেবল ইউনিলিভারেই নেতৃত্ব দিচ্ছে না, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা প্রতিষ্ঠানও দক্ষতার সাথে পরিচালনা করছে।
‘এমপ্লয়ার অব চয়েস’ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের তরুণদের জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসংস্থান গড়ে তুলেছে, যা তরুণদের ভবিষ্যতের উপযুক্ত দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ১ কোটি তরুণ এবং বাংলাদেশে ১০ লাখ তরুণকে দক্ষ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ইউনিলিভার বাংলাদেশ। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণকে শক্তিশালী করতে প্রতিষ্ঠানের পুরো কার্যক্রম জুড়ে ডিইআই অর্থ্যাৎ ডাইভার্সিটি, ইকুইটি অ্যান্ড ইনক্লুশন- এ সকল বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। এ অনন্য উদ্যোগ শুধু ইউনিলিভারে কাজ করা ব্যক্তিদেরই নয়, বরং ভ্যালু চেইনে যুক্ত সকলকেই প্রভাবিত করে।
ইউনিলিভার শীর্ষ করদাতা প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার অর্জন করেছে। গত বছর ইউবিএল ‘এনভায়রনমেন্ট ক্যাটাগরি’তে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ ‘বাংলাদেশ সাসটেইনেবিলিটি এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড’; একটি বৈচিত্র্যময়, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভূক্তিমূলক কর্মশক্তি তৈরির লক্ষ্য বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি পূরণে অনন্য দৃষ্টান্ত অর্জন করায় ‘এফআইসিসিআই ডিইআই চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড’ এবং অ্যাসোসিয়েশন অব চার্টার্ড সার্টিফায়েড অ্যাকাউন্ট্যান্টস (এসিসিএ) এর কাছ থেকে ‘এসিসিএ অনুমোদিত এমপ্লয়ার প্লাটিনাম’- এর স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এছাড়া ‘বাংলাদেশ সি-সুটস এওয়ার্ডস-২০২৩’ অর্জন করেন ইউবিএল- এর ম্যানেজমেন্ট কমিটির দুজন শীর্ষ কর্মকর্তা।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে এক অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছে ইউনিলিভার বাংলাদেশ। দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ, সামাজিক প্রগতি আর পরিবেশ সংরক্ষণ- এই তিনটি ক্ষেত্রে লক্ষ্য অর্জন করতে সমন্বিত ও সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ নিতে অঙ্গীকারবদ্ধ ইউবিএল। জাতিসংঘের বৈশ্বিক লক্ষ্য এবং এ দেশের ২০৪১ সালের রূপকল্প অনুসারে, বেসরকারি খাতসহ সকলকে সম্পৃক্ত করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের কৌশল ও অগ্রাধিকারগুলোর পুনঃবিন্যাস করার মাধ্যমে একটি টেকসই অর্থনীতির দেশ গঠনের লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি।